রক্ত দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতার মাধ্যমে আমরা দেশের ভুখন্ডের সাথে সাথে একটা পতাকাও পাই। শারীরিকভাবে একটুকরো কাপড় হলেও, পতাকা অনেক কিছুকে রিপ্রেজেন্ট ও সিম্বোলাইজ করে, যেমনঃ সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা, স্বকীয়তা, মতামত প্রকাশের অধিকার ইত্যাদি।
এখন কেউ যদি মত প্রকাশে বা অধিকার আদায়ে পতাকা পোড়ায়, তা গ্রহণযোগ্য হবে কি? অবশ্যই না, তাই তো? কিন্তু, সে যদি এই যুক্তি দাঁড়া করায় যে পতাকাতো মত প্রকাশের অধিকারকেই সিম্বোলাইজ করে, তাহলে মত প্রকাশে সে পতাকা পোড়াতেই পারে, সুতরাং সে অধিকার তাকে স্বয়ং পতাকাই দেয়, তখন কী উত্তর দিবেন?
না, উত্তর আছে। লজিক্যাল ফ্যালাসি আখ্যা দিয়ে এড়িয়ে যাওয়ার দরকার পড়বে না। পতাকা মত প্রকাশের অধিকার অর্থাৎ ‘ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন’কে সিম্বোলাইজ করে কিন্তু যা খুশি তা করা অর্থাৎ ‘ফ্রিডম অব অ্যাকশন’কে কিন্তু সিম্বোলাইজ করে না। মোটা দাগে বলতে গেলে, যা খুশি আপনি বলতে পারলেও যা খুশি করার অধিকার আপনি, সে, এবং আমি – আমরা কেউ-ই রাখি না।
সাম্প্রতিককালে মূর্তি ও ভাষ্কর্য ইশ্যুতে যতগুলো লেখা পড়লাম বা ভিডিও দেখলাম – তার প্রত্যেকটিই কোনো না কোনোভাবে পক্ষপাতদুষ্ট, স্বার্থান্বেষী, ভোগাস, এবং মোটা দাগে রাজনৈতিক। এ রাজনীতি স্বার্থের বা অস্তিত্বের। দুটি পক্ষই যে কমন একটা বর্গের উপর দাঁড়িয়ে স্বপক্ষে যুক্তি আওড়াচ্ছে, সেই বর্গের নাম ধর্ম। সেই ধর্মের নাম ইসলাম! এতে করে ক্ষতিটা ইসলামের হচ্ছে বলেই আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক বোঝে। এ ক্ষেত্রে ইসলামের কতটুকি ক্ষতি তারা করছে তা খাতা কলম নিয়ে হিসেব করে বের করা কঠিন।
এর মধ্যে কিছু দিন যেতে না যেতেই আজ কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন ভাষ্কর্য ভেঙে ফেললেন ‘দুষ্কৃতিকারীরা’, এই ‘দুষ্কৃতিকারীরা’ কি অপরিচিত কেউ আদৌ? এই দুষ্কৃতীকারী নামক জাতীয় সুপরিচিত সন্ত্রাসী সংগঠন বরাবরই ইসলামকে তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি মনে করে, যেনো ইজারা নেয়া আছে তাদের বাপ-দাদা কর্তৃক। কেউ তাদের ধর্ম রাজনীতির বারোটা বাজালেই বা ধর্ম ব্যাবসায়ে আঘাত হানে এমন কিছু করলেই তারা নিজ উদ্যোগে ঝাঁপিয়ে পড়েন; ভেঙে ফেলেন জাতির পিতার ভাষ্কর্য, পুড়িয়ে দেন বাউলের ঘর। তারা যেন এই বঙ্গীয়-জনপদে ইসলাম ধর্মের প্লাটিনাম ডিলার। ইসলাম বুঝতে হলে, ভাবতে হলে, মানতে হলে তাদের দেখিয়ে দেয়া মানদন্ডেই মানতে হবে। কেনো, দয়াল? তারা পয়দা না হইলে মানুষ ধর্ম-কর্ম করতো না? নামাজ-রোজা করত না?
অথচ দশ কী বিশ বছর আগেও আমাদের দেশে এমন ছিল না। আমরা সত্যিকার অর্থেই ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’। পঞ্চম শ্রেণী পড়ুয়া আমি আমার দাদার ও নানার উভয় বাড়ির মসজিদেই নিয়ম করে চার বেলা আজান দিতাম। আমি সেই বয়সেই অনেকবার ইমামতি করার ব্যার্থ চেষ্টা করে ধৈর্যচ্যুত হয়েছি। কিন্তু, আমার এতে কোনো অনুযোগ-অভিযোগ ছিলনা। আমাদের সময়ের হুজুরেরা ওয়াজ ব্যাবসা করতেন না। যদিও মেইনস্ট্রিমে কী হতো জানা নাই। তবে, এটা লিখে দেয়া যায়, অন্তত, ওয়াজে এই সময়ের মতো এতো বাজেভাবে অগ্নিঝড়া কন্ঠে ‘মুন্ডু কেটে নিব’, ‘লাশ ফেলে দিব’, বা ‘জীবন নিয়ে নিব’ বলে ‘চিল্লাইয়া বলেন ঠিক কি-না?’ বলা হতো না। তাই, উত্তরও আসতো না ‘ঠিক ঠিক’। অথচ, সেই আমলের হুজুরেরা উঁচু কন্ঠে কথাই বলতেন না। আমাকে এক হুজুর পড়াতেন যার কথা শুনে, তেলাওয়াত শুনেই আমি সাইজ হয়ে গেসিলাম, ভয়ংকর সুন্দর তার মুখের কথা, মধুর তার তেলাওয়াত, এমনকি সে নিজেও।
একটা সময় টিভি বিজ্ঞাপণ কী নাটকের ডায়লগ কী সিনেমার ডায়লগ হিট হতো। মানুষ হাসি ঠাট্টা করতো, এখন হাসি ঠাট্টাতামাসার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে ওয়াজের হুজুরেরা। কেনো এই অধঃপতন? মাহফিলের ‘সিংহাসনে’ বসে যে গজবের কথা তারা বলতে থাকেন, তবে সেটা কিসের উপর পড়লো?
একটা সময় পাড়া মহল্লায় ম্যানারের একটা চেইন সিস্টেমে চলতো সবাই। মুরুব্বি মানা হতো। খারাপ পথে চলার একটা অদৃশ্য ভয় এবং ভালো পথে চলার অনুপ্রেরণা, দুটোই চলতো। কই গেলো সে সময়। এই মোরাল ট্রেনিংগুলোর সিংহভাগই তো আসে সমাজে ধর্মভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো (মসজিদ,মাদ্রাসা,তাবলিগ,জামাত) থেকেই। এখন কই সেই মোরালিটি? চিল্লাইয়া কন কই। এহনই কন কই গেসে সেই দিন। এলাকার নাবিলের বাপ মরহুম জামাল আংকেল আমারদের বাসায় আসলে এক রকম অধিকার নিয়েই আমাকে তুই বলে সম্বোধন করতেন। বকা দিতেন। অনেক কিছু বোঝাতেন। কই কখনোতো এতটুকুও রাগ হয়নিতো আমার। মনে মনে কোনো গালিও তো দেইনি। নুয়ে পড়তাম ওনাকে দেখলে। এই সম্মান এমনি এমনি আসেনি। এটা সোশাল ট্রেনিং থেকে তৈরী। এইযে একটা সমঝোতা, একটা আদব কায়দা, এটা এক সময় এলাকাভিত্তিক ছিল। এখন কই সে দিন? আপনি পারবেন নিজে জামাল হয়ে পাশের বাসার ভাতিজা আকাশকে ভালো-মন্দ বোঝাতে?
ভণ্ড ধর্ম-ব্যাবসায়ীগুলোর অনুসারীগুলোকে আপনি মসজিদে না পেলেও পাবেন শবনম ফারিয়ার ছবির কমেন্টবক্সে, সাকিবের বউয়ের ছবির কমেন্টবক্সে। এদের আপনি কখনই কওমি মাদ্রাসায় শিশু বালাৎকার নিয়ে কিছু বলতে দেখবেন না, কিন্তু মিথিলার ছবির কমেন্টবক্সে এরা চব্বিশঘণ্টা সরব। এদের নৈতিকতার যায়গাটা তৈরী হতে হতেও নষ্ট হয়ে যায় না বুঝে না ভেবে চাল্লাইয়া ‘ঠিক ঠিক’ বলার সাথে সাথেই। এরা তখনই যে কোনো কিছুকেই ঠিক ভাবতে শুরু করে; হোক সে ভাষ্কর্য ভেঙে ফেলা কী বাউলের ঘরে আগুণ দেয়া! এর দায়ভার সেই সকল ধর্ম-ব্যাবসায়ীদের; এদের না!
যাই হোক, পতাকা মতামত প্রকাশের অবারিত স্বাধীনতা দিলেও, সেই মত প্রকাশ করতে গিয়ে পতাকা পোড়ানো যেমন অবৈধ ও অযৌক্তিক, ঠিক তেমনি করেই, ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ে ভাষ্কর্য ভেঙ্গে ফেলাটাও একই ভাবে অযৌক্তিক, হাস্যকর, এবং দুঃখজনক।
লেখকঃ রাইসুল ইসলাম আকাশ
শিক্ষক
০৫ ডিসেম্বরের ২০২০