মায়াবী মুখের গড়ন, মাঝ দিয়ে সিঁথি করা চুল আর সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব- মেছেরকে অনেক দূর থেকেই অন্য সবার থেকে আলাদা করা যেতো সহজেই। পোশাকে কিংবা কথাবার্তায় ভীষণ পরিপাটি মেছের যেন এসেছিলেন হ্যামিলিয়নের বাঁশিওয়ালা হয়ে। রাস্তা দিয়ে যখন হাঁটতেন, মুহূর্তের মধ্যেই পিছে এসে জড়ো হতো যুবক-বৃদ্ধ থেকে শুরু করে শিশুরাও। বড়দের সম্মান, সমবয়সীদের সমীহ আর শিশুদের আদর–মেছেরের নীতি-আদর্শের প্রতি কুতুবপুরবাসীর ভালোবাসা ক্রমেই বাড়ছিলো।
শফিকুর রহমান মেছের কুতুবপুরবাসীর কাছে এক কিংবদন্তির নাম। খেটে খাওয়া মানুষ, গরীব-দুঃখীদের প্রতি যার ছিল অগাধ ভালোবাসা। যে কোনো সমস্যা-অভাব-অভিযোগ নিয়ে তাঁর কাছে গিয়ে খালি হাতে ফিরতো না কেউই। কৈশোরে প্রায়ই নিজের গায়ের জামা কিংবা পকেটের সব টাকা অভাবী কাউকে দিয়ে খালি গায়ে, শূন্য পকেটেই ফিরেছেন বাড়ি।
শৈশবেই অনুভব করেন রাজনীতির প্রতি তুমুল ভালোবাসা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের অনুপ্রাণিত হয়ে জড়ান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। দলের দুঃসময়ের এই সৈনিক দলের প্রয়োজনে লড়াই করেছেন বুক চিতিয়ে। ১৯৮৪ সালে চট্টগ্রামের লালদীঘির ময়দানে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গুলি-বোমা হামলা ঠেকাতে গিয়ে হন গুলিবিদ্ধ। তবুও আওয়ামী লীগের রাজনীতি ছাড়েননি, বরং ক্রমেই হয়ে উঠেন শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত ব্যক্তিত্বে।
দলকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে লড়াই-সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন। ছাত্রলীগের রাজনীতিতে তাঁর অবদান আজও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন সবাই। ১৯৯৬ সালে বইমেলায় শেখ হাসিনার উপর হামলাও প্রতিহত করা হয় মেছেরের নেতৃত্বে।
কুতুবপুরের নীপিড়িত-নিষ্পেষিত, অবহেলিত মানুষের জন্য আলোকবর্তিকা ছিলেন মেছের। রাজধানীর কাছের এই অঞ্চলকে উন্নত করে তুলতে তাঁর প্রয়াস চিরস্মরণীয়। মেছেরের তুমুল জনপ্রিয়তা দেখে অসংখ্য মুরুব্বী তাঁকে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করার অনুরোধ জানান। কিন্তু মেছেরের স্বপ্ন ছিল আরো উঁচুতে। তিনি বলতেন, মুরুব্বীরা চাইলে আমি সংসদে গিয়ে মানুষের জন্য কথা বলবো।
এরই মধ্যে নেত্রীর কথামতো মহানগর ছাত্রলীগের সিনিয়র সহসভাপতি পদ থেকে কেন্দ্রীয় যুবলীগে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। তাঁর সংসারেও তখন স্ত্রী ও ফুটফুটে দুই ছেলে।

কুতুবপুরকে তিলোত্তমা করে তুলতে ভীষণ অল্প সময় পেয়েছিলেন মেছের। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে দেড় বছরেরও কম সময়ে স্থানীয় সাংসদ শামীম ওসমানের কাছ থেকে কুতুবপুরের অনেকগুলো রাস্তার কাজ নিয়ে আসেন, সম্পন্নও করেন।
কিন্তু ঘাতকের নির্মম বুলেট বাঁচতে দেয়নি মেছেরকে। ১৯৯৭ সালের ১১ অক্টোবর ঢাকার মালিবাগে ঘাতকদের হাতে নিহত হন তিনি। মেছের আর নেই- এই খবর কুতুবপুরে আসামাত্রই স্তব্ধ হয়ে যায় ঢাকা ও কুতুবপুর। লাখো লোকের আর্তচিৎকার, কান্নার সেই দৃশ্য রোমন্থন করেন অনেকেই। জনগণের আন্দোলন, বিক্ষোভে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকে সারাদিন। মেছেরকে শেষ বিদায় জানাতে ঢল নামে অসংখ্য মানুষের। তিল ধারণের ঠাই ছিল না তাঁর জানাযাতে। মাঠ, অলিগলি পেরিয়ে প্রধান সড়ক- যেদিকে দু চোখ যায়, ছিল শুধু মানুষ আর মানুষ। অশ্রুসিক্ত জানাযা শেষে দাফন করা হয় মেছেরকে। ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় তাঁর সমাধি।
কুতুবপুরকে তিলোত্তমা করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন মেছের। তাঁর সহকর্মী, বন্ধুদের প্রায় সবাই আজ মন্ত্রী, এমপি কিংবা সরকারের বড় পদে আসীন। মেছের বেঁচে থাকলে তিনিও অনেকদূর যেতেন, এমনটিই বিশ্বাস সকলের।
মেছের স্বপ্ন দেখতেন, তাঁর বংশের সন্তানেরা সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মানুষের সেবা করবে। বাবার স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা মেছেরের ছেলেরাও আজ বড় হয়েছে। তাঁর বড় ছেলে, ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন মেধাবী ছাত্র ডাঃ সিকদার মোঃ গোলাম মর্তুজা সৌরভ ৩৮ তম বিসিএসে সারাদেশের সাড়ে চার লক্ষ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৫৯তম স্থান অর্জন করেছে। অচিরেই প্রশাসনের সম্মানজনক পদে অধিষ্ঠিত হবেন তিনি। ৩৯তম বিসিএসেও সাফল্যের সঙ্গে উতরে যান সৌরভ। নিয়োগ পেয়ে বর্তমানে সার্জন হিসেবে কর্মরত আছেন মুগদা জেনারেল হাসপাতালে।
মেছেরের ছোট ছেলে ফাহিমুর রহমান উৎসব কম্পিউটার সাইন্স নিয়ে পড়ছেন ঢাকার স্বনামধন্য একটি বিশ্ববিদ্যলয়ে। বাবাকে মাত্র দেড় বছর কাছে পাওয়া উৎসব আজও বাবার ছবি দেখলে অপলক তাকিয়ে থাকেন।
কুতুবপুরের নয়নের মণি মেছেরকে হারানোর পেরিয়েছে প্রায় ২৩ বছর। সাধারণ জনগণ আজও তাঁর শূন্যতা অনুভব করে। দলকে সুসংগঠিত করা মেছেরবিহীন কুতুবপুরে এখন দলের চেইন অব কমান্ড নেই, এমনটিই মনে করেন অধিকাংশ ব্যক্তি। সে কথা ঘুরেফিরেই আসছে মানুষের মুখে মুখে। আসছে মেছেরের নামও। জনসাধারণের মতে, রাজনীতির প্রবাদপুরুষ মেছেরের শূন্যতা কুতুবপুরবাসী আজীবন অনুভব করবে। তাঁর অনুপস্থিতি ভোগাচ্ছে ও ভোগাবে কুতুবপুরের আওয়ামী লীগকেও।